পথ-ভোলা কবি

পথ-ভোলা কবি

জসীম উদ্দীন

(আল্লামা ইকবালকে উদ্দেশ্য করে লেখা)

পথ-ভোলা কবি। গোলাপ ফুলের পল্লবে বাঁধি ঘর

গন্ধের গুঁড়া সঞ্চয় করি’ সারাটি জনম ভর,

বুলবুলিদের কণ্ঠে পুরিয়া ছড়াইছ দেশে দেশে;

রামধনুকের সাত-রঙা পথে চলেছে তা ভেসে ভেসে।


হে রঙিলা কবি! তোমার সাকীর রঙিন ঠোঁটেতে ঢুকে’

ফুলের বরণ, গজলের গানে ছড়াইছ মিঠে সুখে।

তারি এতটুকু বাঁশীতে পুরিয়া আমরা দিওয়ানা হয়ে

বিকাই কত না সমরকন্দ বোখারার সুখালয়ে।

জায়নামাজের পাটি ভিজে’ যায় তোমার ‘সুরা’র স্রোতে;

হীরামন-তোতা ডানা মেলে’ উড়ে বন্ধ সে খাঁচা হ’তে।


তোমার কথা তো মেহেদির পাতা, ঘষিতে সে রঙ ধরি’

ডুগু ডুগু করে; নতুন বধূরা অধর পেয়ালা করি’

বিলাইয়া দেয় দয়িতের ঠোঁটে সুখ-বাসরের রাতে।

চাঁদ যে ছড়ায় জোছনা-মদিরা জেগে তাহাদের সাথে।


ওগো দরবেশ! চলিয়াছ তুমি খোরমা-খেজুর ছায়ে

মেশ্ক্ হ’তে সে কস্তুরী-বাস ছড়ায়ে মরুর বায়ে;

ভূত-ভবিষ্য-বর্তমানেরে মুঠার মাঝারে ধরি’

তুমি কারিকর, গড়েছ তাদের মনের মতন করি’।

মহাকাল তব আজ্ঞাবাহক, নখ-ইঙ্গিতে তব

কত দেশে দেশে ভাঙিছে গড়িছে ইতিহাস অভিনব।


ইসমে-আজম পড়িয়া চলেছ অন্তরীক্ষ থেকে;

জীবন-কুসুম ফুটিয়া উঠিছে বেহেশ্ত গায়ে মেখে।

আমি কি তোমারে ডাক দিব আজ আমাদের আঙিনায়,

এইখানে এই ভাঙা কুঁড়ে-ঘরে কলাপাতা ঘেরা ছায়।

ক্ষুধার আহার মেলেনি যাদের, পরের ক্ষুধার লাগি’

রচিতেছে সুধা লাঙল খুঁড়িয়া দিবস রজনী জাগি;

কদাকার এই ধরণীরে যারা করেছে ফসল-বাগ,

তাহাদের পেটে জ্বলিছে চুল্লি দারুণ ক্ষুধার আগ।

তুমি কি ক্ষণেক দাঁড়াবে হেথায় তাহাদের ভাষা হয়ে,

হানিবে আঘাত অসাম্য-ভরা আজিকার লোকালয়ে?

গরীবের তরে তখ্ত তাউস্ আজো তো হয়নি গড়া;

কি করে পড়িবে তোমার নান্দী গোরস্তানের মড়া?

মিথ্যা তোমারে আহ্বানি’ কবি করিলাম অপমান;

আমরা আজিও প্রস্তুত নহি লইতে তোমার দান।

মানুষেরে মোরা দিতে পারি নাই মানুষের অধিকার;

মানুষেরে লয়ে শিখিয়াছি শুধু বিকি-কিনি কারবার।

অহমিকা ভরে একের কথারে পুরিতে আরের মুখে

ব্যর্থ প্রয়াস করিয়া ফিরিছি আমরা নকল সুখে।

হানো হানো কবি, আমাদের ’পরে নিদারুণ অভিশাপ;

জ্বলে’ পুড়ে’ যাক্ দাহনে তাহার অতীতের কৃত পাপ ॥

(মাহে নও, পঞ্চম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, এপ্রিল ১৯৫৩, বৈশাখ,

১৩৬০)

@top fans #সাহিত্যনামা

Previous Post Next Post