মুসা আল হাফিজ
সূত্র: আলোকিত বাংলাদেশ (২৯ আগস্ট, ২০২২)
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১) আধ্যাত্মিকতার মূলে আছে বিশ্ব নিয়ন্ততার প্রতি বিশ্বাস। ‘সীমার মাঝে অসীম তুমি/বাজাও আপন সুর/আমার মধ্যে তোমার প্রকাশ/তাই এত মধুর।’ এখানে ক্রিয়াশীল ছিল জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের ভাবসাধনা, ফার্সিকাব্য সংযোগ, উপনিষদ এবং ব্রাহ্মসমাজ ও রাজা রামমোহন রায়ের (১৭৭২-১৮৩৩) প্রভাব। রবীন্দ্রমনে আধ্যাত্মিক যে বোধ তৈরি হয়, তা ব্রাহ্মমতের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়েছিল বৈদিক মন্ত্রের আত্মাকে। কিন্তু বৈদিক আচারের ওপর প্রাধান্য দিয়েছিল বেদান্তবাদী হৃদয়ের ধর্মকে।
‘বৃথা আচার বিচার। সমাজের চেয়ে
হৃদয়ের নিত্য ধর্ম সত্য চিরদিন।’
হৃদয়ের ধর্মের অন্বেষা পরম সত্তা। যিনি সব মানুষের হৃদয়ে মহত্ত্বের ও শ্রেয়োবোধের প্রেরণা দিচ্ছেন। চিত্রার ‘এবার ফিরাও মোরে’ কবিতায় তার পরিচয় আছে।
‘কে সে? জানি না কে? চিনি নাই তারে
শুধু এইটুকু জানি- তারি লাগি রাত্রি-অন্ধকারে
চলেছে মানবযাত্রী যুগ হতে যুগান্তর-পানে
ঝড়ঝঞ্ঝা বজ্রপাতে জ্বালায়ে ধরিয়া সাবধানে
অন্তরপ্রদীপখানি।...’
রবীন্দ্রনাথের মরমিতা গভীরভাবে উজ্জীবিত ও বিনির্মিত ছিল ফারসি ও হিন্দি কবিতার সুফি ভাবরসে। শেখ সাদী (১২১০-১২৯১) হাফিজ (মৃত্যু : ১৩৮৯) বা রুমি (১২০৭-১২৭৩) প্রতিধ্বনিত হয়েছেন রবীন্দ্রনাথের কবিতায় কবিতায়। সুফিবাদের মন, তার অপার্থিব মিলনতিয়াস এবং পরমানন্দময় ভাবাবেশের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ কত গভীরভাবে একাত্ম ছিলেন, তার বিবৃতি নিজেই দিয়েছেন পারস্য যাত্রী সফরনামায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্বপুরুষ ফারসি ভাষার বন্ধনে যুক্ত ছিলেন হাফিজ-রুমিদের অধ্যয়নে। বাংলার সম্ভ্রান্ত পরিবারগুলোতে বাংলার সঙ্গে ফারসি চর্চা হতো অষ্টাদশ শতকে, এমনকি উনিশ শতকের গোড়ার দিকেও। মুসলমান কবিরা তো বটেই, হিন্দু কবি ও শিক্ষিত শ্রেণি ফারসিকে উপেক্ষা করতেন না। ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর (১৭১২-১৭৬০) ফারসি শিখেছিলেন এবং এ নিয়ে ছিল তাঁর গর্ব, মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩) শিখেছিলেন ফারসি ভাষা, সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের (১৮৮২-১৯২২) ফারসি দক্ষতা ছিল প্রশংসনীয়।
জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে ফারসি চর্চার ঐতিহ্য ছিল পুরোনো। বাংলার পাশাপাশি ফারসিতেও কথা বলতেন এ পরিবারের সদস্যরা। সুফি কবিদের ভাবলোকের সঙ্গে আত্মীয়তা পেতেছিল রামমোহনের চিন্তা ও ভাববাদ। এরই প্রত্যক্ষ উত্তরাধিকার ধারণ করে ঠাকুর পরিবার। রবীন্দ্রনাথের বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫) ব্রাহ্মধর্মের একনিষ্ঠ অনুসারী ছিলেন। এ পরিবারে রুমির ‘মসনবি’, ফেরদৌসির (৯৪০-১০২০ ‘শাহনামা’, হাফিজের ‘দিওয়ান’ এবং নেযামীর (আ. ১১৪১-১২০৯) ইউসুফ-জুলেখার মতো কাব্য পঠিত হতো। এ পঠন ছিল এতোই মগ্নতা ও মুগ্ধতার, যা রবীন্দ্রনাথের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাফিজের সমগ্র ‘দিওয়ান’ মুখস্থকরণ থেকে স্পষ্ট হয়। তাঁকে বলা হতো ‘হাফিজে হাফেজ’। এ পরিবার মোঘল সংস্কৃতির দ্বারা কতো গভীরভাবে প্রভাবিত ছিল, তার বিবরণী দিয়েছেন বিচারপতি কামালউদ্দিন হোসেন তার ‘রবীন্দ্রনাথ ও মুঘল সংস্কৃতি’ বইয়ে। ছেলেদের ফারসি ভাষা শিক্ষাদানের জন্য বাড়িতে ফারসি মুন্সীও নিয়োগ দিয়েছিলেন দেবেন্দ্রনাথ।
এই পরিবেশে রবীন্দ্রনাথের বেড়ে ওঠা ও বিকাশ। ফারসি সুফি কবিদের আপন জেনেই এবং তাদের ভাব ও সুরের সংহতির মধ্যে রবীন্দ্রনাথের মানসগঠন। এর অকুণ্ঠ উচ্চারণ প্রবীণ রবীন্দ্রনাথের কাছে শোনা যায়, যখন ইরানের সিরাজ শহরে সফররত রবীন্দ্রনাথ সংবর্ধনা সভায় বক্তব্য রাখছিলেন। বক্তব্যে তিনি বলেন- ‘আপনাদের পূর্বতন সূফি সাধক কবি ও রূপকার যারা আমি তাদেরই আপন, এসেছি আধুনিককালের ভাষা নিয়ে; তাই আমাকে স্বীকার করা আপনাদের পক্ষে কঠিন হবে না।‘ (পারস্য যাত্রী, পৃষ্ঠা ৪১)।
রবীন্দ্রনাথ যখন হাফিজের সমাধির পাশে গেলেন, তখন তার সে হাস্যোজ্জ্বল চোখের সংকেত অনুভব করেন, যা তার মানসলোকে মুদ্রিত হয়ে আছে বহু আগ থেকে, নিজেকে হাফিজের পানশালার সখা হিসেবে করেন ব্যক্ত। কারণ তিনি তো হাফিজের চিরকালের জানা লোক :
‘এই সমাধির পাশে বসে আমার মনের মধ্যে একটা চমক এসে পৌঁছল, এখানকার এই বসন্তপ্রভাতে সূর্যের আলোতে দূরকালের বসন্তদিন থেকে কবির হাস্যোজ্জ্বল চোখের সংকেত। মনে হলো আমরা দু’জনে একই পানশালার বন্ধু, অনেকবার নানা রসের অনেক পেয়ালা ভরতি করেছি। আমিও তো কতবার দেখেছি আচারনিষ্ঠ ধার্মিকদের কুটিল ভ্রূকুটি। তাদের বচনজালে আমাকে বাঁধতে পারেনি; আমি পলাতক, ছুটি নিয়েছি অবাধপ্রবাহিত আনন্দের হাওয়ায়। নিশ্চিত মনে হলো, আজ কত-শত বৎসর পরে জীবন-মৃত্যুর ব্যবধান পেরিয়ে এই কবরের পাশে এমন একজন মুসাফির এসেছে যে মানুষ হাফেজের চিরকালের জানা লোক।’ (পারস্য যাত্রী, পৃষ্ঠা ৪৩)।
রবীন্দ্রনাথের ওপর হাফিজের প্রভাব শুধু সূক্ষ্ম, তা নয়। সরাসরি প্রভাবও সোচ্চার। এর জ্বলন্ত স্বাক্ষর রয়েছে কবিতায় কবিতায়। আমরা পাঠ করতে পারি রবীন্দ্রনাথের কবিতা :
ছিন্ন ক’রে লও হে মোরে,
আর বিলম্ব নয়।
ধুলায় পাছে ঝ’রে পড়ি
এই জাগে মোর ভয়।
এ ফুল তোমার মালার মাঝে
ঠাঁই পাবে কি জানি না যে,
তবু তোমার আঘাতটি তার
ভাগ্যে যেন রয়।
ছিন্ন করো, ছিন্ন করো,
আর বিলম্ব নয়।
কখন যে দিন ফুরিয়ে যাবে-
আসবে আঁধার ক’রে,
কখন্ তোমার পূজার বেলা
কাটবে অগোচরে।
(গীতাঞ্জলি : গীত সংখ্যা ৮৭)
পাশাপাশি হাফিজের এই কবিতা পড়ুন :
মিলনের বারতা কোথা? আমায় ঊর্ধ্বে নেবে ডেকে-
বরণ করতে তোমায়, ধুলোর ধরা ছেড়ে যাব ঊর্ধ্বলোকে!
প্রাণ আমার নীড় চেনা সেই পাখির মতো স্বর্গ কামনায়,
ধরার ফাঁদ এড়িয়ে কেবল ঊর্ধ্বপানেই ধায়।
ডাকবে যখন প্রণয় স্বরে তোমার চরণসেবায়,
সুদূরপানে উঠবো ফেলে ক্ষণ কালের সীমায়
বাধা জগৎ-সংসার আর নশ্বর এ জীবন;
হে প্রভু! তোমার করুণা মেঘ হতে করো বর্ষণ।
সরাসরি প্রভাব কেবল হাফিজ রেখেছেন, তা নয়। রবীন্দ্রনাথকে কাব্য-ভাবনা ও উপাদান সরবরাহ করেছেন হাকিম সানাই (১০৮০-১১৩১), শেখ সাদী, আমীর খসরু(১২৫৩-১৩২৫), জালালুদ্দীন রুমী প্রমুখ। একটি দৃষ্টান্ত দেয়া যাক শেখ সাদী ও রবীন্দ্রনাথের কাব্যমিলের। রবীন্দ্রনাথ লিখেন :
গগনতল গিয়েছে মেঘে ভরি,
বাদল-জল পড়িছে ঝরি ঝরি।
এ ঘোর রাতে কিসের লাগি
পরান মম সহসা জাগি
এমন কেন করিছে মরি মরি।
সুফি কবি শেখ সাদী লিখেছিলেন:
মেঘ থেকে এক বিন্দু বারি পড়ে ঝরে
সাগরের বিশালতা দেখে সে লাজে বুঝি মরে :
কী অসীম এ সাগর আর আমি কত হীন!
যেথায় এ সাগর বিরাজে আমি সেথা লীন।
হাফিজ বা রুমির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের নানা কাব্যের মিল এত প্রগাঢ় ও প্রখর, যা খোলা চোখেই ধরা পড়ে। মিলগুলো চিত্রনির্মাণের ধারা ও ধরনে, কাব্য স্থাপত্যের বৈচিত্র্যে, গতিবিধির বর্ণিলতায় এবং গভীরতার সংগঠনেও সক্রিয়। পারস্যে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘আপনাদের পূর্বতন সূফি সাধক কবি ও রূপকার যাঁরা, আমি তাঁদেরই আপন, এসেছি আধুনিক কালের ভাষা নিয়ে।’ সেই যে তাদের সখা হিসেবে রবীন্দ্রনাথ নিজেকে ব্যক্ত করলেন, তার কবিতা সেটা করে আরো বেশি। সেখানে রবীন্দ্রনাথের মনোলোকে গভীর শেকড় পেতে সুউচ্চ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে সুফিবাদ ও ব্রাহ্মবাদ। যদি সেই সব মহান কবির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের মিল সন্ধান করা হয়, তাদের অলৌকিক জ্যোতির্ময়তাকে বাণীদান, রস, রসাবেগ , রসবোধ ও চিত্তের বেদনা এবং মহত্ত্বের অধিষ্ঠানে একে অন্যকে প্রতিফলিত করণের দিক থেকে, তাহলে বহু ক্ষেত্রে হাফিজ-রুমি থেকে রবীন্দ্রনাথকে আলাদা করা কঠিন হবে খুবই কঠিন। যেভাবে হুসাইন ইবনে মনসুর হাল্লাজের (৮৫৮- ৯২২) পরমের সঙ্গে একাত্মবোধের আনাল হক জাতীয় কাব্য থেকে আলাদা করা কঠিন হয় রবীন্দ্রনাথের উচ্চারণকে, যখন তিনি বলেন- ‘তুমি আর আমি/মাঝে কেহ নাই/কোন বাধা নাই ভুবনে।’
কীভাবে রবীন্দ্রনাথে রুমির প্রভাবকে উপেক্ষা করা যায়, যখন রুমির প্রতিধ্বনি রবীন্দ্রনাথে হয় বারবার, সরাসরি; পার্থক্য থাকে শুধু ভাষার। রুমি তার দিওয়ানে লিখেন-
বায্ আঁ, বায আঁ
হর আঁচে হাস্তী বায আঁ।
গর কাফির গর গবর ওয়া
বোত পরস্তী বায আঁ।
ইঁ দরগাহে মা দরগাহে
না উমেদি নীস্ত।