আজ ২৪ মে, জাতীয় কবি কাজী নজরুল
ইসলামের ১২৬ তম জন্মজয়ন্তী। "যদি আর বাঁশী না বাজে" অভিভাষণের মধ্য দিয়ে
আমরা সাহিত্যনামা পরিবার গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি এই মহান কবি কে।
বন্ধুগণ,
আপনারা যে সওগাত আজ হাতে তুলে দিলেন
আমি তা মাথায় তুলে নিলুম। আমার সকল দ্যোন মন ও প্রান আজ বীনার মত বেজে উঠেছে । তাতে
শুধু একটি মাত্র সুর ধ্বনিত হয়ে উঠছে - আমি ধন্য হলুম, আমি ধন্য হলুম। আমায় অভিনন্দিত
আপনারা সেই দিনই করেছেন যেদিন আমার লেখা আপনাদের ভালো লেগেছে।
বিংশ শতাব্দির অসম্ভবের সম্ভাবনার
যুগে আমি জন্মগ্রহন করেছি, এরই অভিযান সেনা দলের তূর্য বাদকের একজন আমি, এই হোক আমার
সবচেয়ে বড় পরিচয়। আমি এই দেশে, এই সমাজে জন্মেছি বলেই শুধু এই দেশের, এই সমাজেরই নই,
আমি সকল দেশের সকল মানুষের।।
কবি চায়না দান, কবি চায় অঞ্জলী,
কবি চায় প্রীতি। কবিতা আর দেবতা সুন্দরের প্রকাশ। সুন্দরকে স্বীকার করতে হয় যা সুন্দর
তাই দিয়ে। সুন্দরের ধ্যান, তার স্তবগান ই আমার ধর্ম। তবু বলছি আমি শুধু সুন্দরের হাতে
বীণা পায়ে পদ্মফুলই দেখিনি, তার চোখে চোখ ভরা জল ও দেখেছি। শ্মশানের পথে, গোরস্থানের
পথে তাকে ক্ষুদা জীর্ন মূর্তিতে ব্যথিত পায়ে চলে যেতে দেখেছি, যুদ্ধভুমিতে তাকে দেখেছি,
কারাগারের অন্ধকুপে তাকে দেখেছি, ফাসির মঞ্চে তাকে দেখেছি। আমাকে বিদ্রোহী বলে খামোখা
লোকের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছেন কেউ কেউ। এই নিরীহ জাতটাকে আঁচড়ে কামড়ে তেড়ে নিয়ে বেড়াবার
ইচ্ছা আমার কোনদিনই নেই। আমি বিদ্রোহ করেছি, বিদ্রোহের গান গেয়েছি অন্যায়ের বিরুদ্ধে,
অত্যাচার এর বিরুদ্ধে। যা মিথ্যা, কলুষিত, পুরাতন, পঁচা, সেই মিথ্যা সনাতনের বিরুদ্ধে,
ধর্মের নামে ভন্ডামি ও কুসংস্কার এর বিরুদ্ধে।
কেউ বলেন আমার বানী জবন কেউ বলেন
কাফের। আমি বলি ও দুটোর কোনটাই না। আমি শুধু হিন্দু মুসলিম কে এক জায়গায় ধরে নিয়ে হ্যান্ডশেক
করানোর চেষ্টা করেছি, গালাগালি কে গলাগলি তে পরিনত করার চেষ্টা করেছি। সে হাত এ হাত
মেলানো যদি হাতাহাতি থেকে অশোভন হয়ে থাকে তাহলে ওরা আপনিতেই আলাদা হয়ে যাবে। আমার গাঁটছড়ার
বাঁধন কাটতে তাদের কোন বেগ পেতে হবেনা, কেননা একজনের হাতে আছে লাঠি আরেকজনের আস্তিনে
আছে ছুরি। হিন্দু মুসলিম দিনরাত হানাহানি জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ, যুদ্ধ বিগ্রহ, মানুষের
জীবনে একদিকে কঠোর দারিদ্র, রীন, অভাব অন্যদিকে লোভী ও সুদেচক্রের ব্যাংকে কোটি কোটি
টাকা পাষান স্তুপের মত জমা হয়ে আছে। এ অসাম্য ভেদ দুর করতেই আমি এসেছিলাম। আমার কাব্যে,
সঙ্গীতে, কর্মজীবনে অভেদ সুন্দর সাম্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম।
আমি যশ চাইনা, খ্যাতি চাইনা, প্রতিষ্ঠা
চাইনা, নেতৃত্ব চাইনা। জীবন আমার যত দুঃখময় হউক, আনন্দের গান, বেদনার গান গেয়ে যাব
আমি। দিয়ে যাব নিজেকে নিঃশেষ করে সকলের মাঝে বিলিয়ে। সকলের বাঁচার মাঝে থকব আমি বেঁচে
- এই আমার ব্রত, এই আমার সাধনা এই আমার তপস্যা।
রবীন্দ্রনাথ আমায় প্রায়ই বলতেন,
দেখ উন্মাদ, তোর জীবনে শেলীর মত, কীটস্ মত খুব বড় একটা ট্রজেডি আছে, তুই প্রস্তুত হ্।
জীবনে সেই ট্রজেডি দেখবার জন্য আমি কতদিন অকারনে অন্যের জীবন অশ্রুর পরশে আচ্ছন্ন করে
দিয়েছি, কিন্তু আমারই জীবনে রয়ে গেল বিশুষ্ক মরুভুমির মত তপ্ত, মেঘের উর্ধ্বে শুণ্যে
র মত কেবল হাসি, কেবল গান ,কেবল বিদ্রোহ। আমার বেশ মনে পড়ছে একদিন আমার জীবনের মহা
অনুভূতির কথা। আমার ছেলে মারা গেছে, আমার মন তীব্র পুত্রশোকে যখন ভেঙ্গে পড়ছে ঠিক সেই
দিনই সেই সময় আমার বড়িতে হাসনা হেনা ফুটেছে, আমি প্রান ভরে হাসনা হেনার গন্ধ উপোভোগ
করেছিলাম। আমার কবিতা ,আমার গান আমার জীবনের অভিজ্ঞতার মধ্য হতে জন্ম নিয়েছে।
যদি কোনদিন আপনাদের প্রেমের প্রবল
টানে আমাকে আমার একাকিত্বের পরম শুণ্য থেকে অসময়ে নামতে হয়, সেদিন মনে করবেন না আমি
সেই নজরুল, সেই নজরুল অনেকদিন আগে মৃত্যুর খিড়কি দুয়ার দিয়ে পালিয়ে গেছে। মনে করবেন
পূর্ণত্বের তৃষ্ণা নিয়ে যে একটি তরুন এই ধরায় এসেছিল, অপূর্ণতার বেদনায় তারই বিগত আত্মা
যেন স্বপ্নে আপনাদের মাঝে কেঁদে গেল।
যদি আর বাঁশী না বাজে, আমি কবি
বলে বলছিনে, আমি আপনাদের ভালবাসা পেয়েছিলাম সেই অধিকারে বলছি, আমায় আপনারা ক্ষমা করবেন,
আমায় ভুলে যাবেন। বিশ্বাস করুন, আমি কবি হতে আসিনি আমি নেতা হতে আসিনি, প্রেম দিতে
এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম। সেই প্রেম পেলাম না বলে এই প্রেমহীন নীরস পৃথীবি থেকে
নীরব ও অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম।।
যেদিন আমি চলে যাব, সেদিন হয়তবা
বড় বড় সভা হবে, কত প্রশংসা কত কবিতা বেরুবে হয়ত আমার নামে। দেশপ্রেমি, ত্যাগী, বীর,
বিদ্রোহী - বিশেষনের পর বিশেষন ।টেবিল ভেঙ্গে ফেলবে থাপ্পড় মেরে, বক্তার পর বক্তা।
এই অসুন্দরের শ্রদ্ধা নিবেদনের
শ্রাদ্ধদিনে বন্ধু তুমি যেন যেওনা। যদি পারো, চুপটি করে বসে আমার অলিখিত জীবনের কোন
একটি কথা স্মরন কর। তোমার ঘরের আঙিনায় বা আশে পাশে যদি একটি ঝরা পায়ে পেঁষা ফুল পাও
সেইটিকে বুকে চেপে বল, বন্ধু, আমি তোমায় পেয়েছি।
তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু আর আমি
জাগিবনা
কোলাহল করি সারাদিনমান কারো ধ্যান
ভাঙিবনা
নিশ্চল নিশ্চুপ আপনার মনে পুঁড়িব
একাকী
গন্ধ বিঁধুর ধুপ।